হাসপাতালের বর্জ্য জীবাণুমুক্ত না করেই একটি চক্র বিক্রি করছে বাইরে। যা আবার নানা হাত ঘুরে স্থান করে নিচ্ছে বিভিন্ন ওষুধের দোকান, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। এতে ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
‘চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) এই তথ্য জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
দুই শতাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে টিআইবি। এ ছাড়া তারা চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কাজটি হয়েছে ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা-বর্জ্য রাখার জন্য পাত্র নেই। ৮৩ শতাংশ হাসপাতালে বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
হাসপাতালের দুই ধরনের চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বাইরে বিক্রি করা হয়। এর একটি পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য ও অন্যটি পুনঃচক্রায়নযোগ্য বর্জ্য। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ (সিন্ডিকেটের অংশ) পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য যেমন, ব্যবহৃত কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ ও রাবার বা প্লাস্টিক নল নষ্ট না করে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহকারীর (সিন্ডিকেটের অংশ) কাছে বিক্রি করে দেয়।
পরবর্তীতে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সঠিক প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত না করেই পরিষ্কার ও প্যাকেটজাত করে ওষুধের দোকান, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে বিক্রি করে দেয়। এসব উপকরণ সঠিকভাবে জীবানুমুক্ত করা হয় না। ফলে এসব উপকরণ পুনঃব্যবহারে এইচআইভিসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
একইভাবে হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ পুনঃচক্রায়নযোগ্য চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, রক্তের ব্যাগ ও নল, ধাতব উপকরণ ইত্যাদি) নষ্ট বা ধ্বংস না করে সংক্রামিত অবস্থাতেই ভাঙ্গারির দোকানে এবং রিসাইক্লিং কারখানাগুলোতে (সিন্ডিকেটের অংশ) বিক্রি করে দেয়। সংক্রমিত অবস্থায় এসব বর্জ্য পরিবহণ করার ফলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মী ও রিসাইক্লিং কারখানার কর্মীদের বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বাড়ে।
একটি জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে টিআইবি।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্জ্য সংরক্ষণ পাত্রে বর্জ্যের ধরণ অনুযায়ী কালার কোড থাকা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও হাসপাতালগুলোতে এই নির্দেশনা মানা হয় না। সার্বিকভাবে ২৯ শতাংশ হাসপতালের বর্জ্য সংরক্ষণের পাত্রে কালার কোড নেই এবং ৫১ শতাংশ পাত্রে সাংকেতিক চিহ্ন নেই।
এ ছাড়া কোভিড-১৯ ও সাধারণ চিকিৎসা বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য পুনঃব্যবহার রোধে ব্যবহৃত রাবার বা প্লাস্টিক নল ও বিভিন্ন ব্যাগ টুকরো করে কাটার নির্দেশনা থাকলেও তা প্রতিপালনে ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবে ২৮ শতাংশ হাসপাতালে ব্যবহৃত রাবার বা প্লাস্টিকের ব্যাগ কাটা হয় না।
গাইডলাইন অনুযায়ী পুনঃব্যবহার রোধ করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত সূঁচ ব্যবহারের পরপরই ধ্বংস বা গলিয়ে দিতে হয়। দেখা যায়, ৪৯ শতাংশ হাসপাতালে সূচ ধ্বংসকারী (নিডল ডেস্ট্রয়ার) যন্ত্রটি নেই।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও বর্জ্যের অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। তারা বর্জ্য নষ্ট না করে কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়। একটি সুপরিচিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কালোবাজারে প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্যের অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনেিআরও বলা হয়, সরকারি হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে ২ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা থেকে পর্যন্ত লেনদেন হয়। ৫৫ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ হয় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ৪৬ শতাংশ, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে ৪২ শতাংশ ও সরাসরি ঘুসের মাধ্যমে ১৪ শতাংশ বর্জ্য কর্মীর নিয়োগ হয়।
অনলাইনে আয়োজিত এবং সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে টিআইবি। এ সময় টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ অন্য কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া সক্ষমতা তৈরির ঘাটতি রয়েছে। বর্জ্য বিনষ্ট না করে অনিয়ম, দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত না করে বিক্রির ফলে ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। ’